অসিতদার লেখা বি ই কলেজের স্মৃতিচারণ পড়ে মনটা খুবই উদ্বেলিত হল। তারপর ফোনে তোমার সঙ্গে কথায় প্রাক্তনী সমাবেশে রবাহুত হয়েই যাত্রার ব্যবস্থা করলাম। আরও অনুপ্রাণিত হলাম যখন তুমি আমাকে লিখতে বললে। পরে সংশয় দেখা দিল – আমি ত’ গল্পতরু নই যে ঝাকালেই গল্প পড়বে। অনেক যুদ্ধের পর, মনে সাহস সঞ্চয় করে প্রচেষ্টা করছি।
আমি একটু আগের থেকেই আরম্ভ করছি। ১৯৫১ সাল – আমি তখন ঝাড়গ্রামে ক্লাস সেভেনে পড়ি। নামেই মেদিনীপুরের মহকুমা সহর, বিদ্যুৎ নেই, রাত্রে প্রায়শঃই ফেউয়ের ডাক শোনা যেত। সেদিন স্কুলফেরৎ বাড়ীতে চারজন যুবক বাবার সঙ্গে আলোচনা করছেন বিদ্যুতায়ন প্রসঙ্গে। তারা বি ই কলেজের ইলেক্টলিক্যালের তৃতীয় বৎসরের ছাত্র। গ্রাম বৈদ্যুতিকরণ নিরিক্ষা প্রকল্পে নিযুক্ত। তাদের একজন বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় ইলেকট্রনিক্মের সম্বন্বে বললেন, যে এই প্রযুক্তিদ্বারা মেঘের আড়াল থেকেও বিমান ওঠান-নামান হচ্ছে। স্বভাবতই আমার চোখছুটো জ্বল জ্বল করে উঠল। ১৯৫৪ সালে চলে আসি বীরভূম জেলার সিউড়িতে। সেখানে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু সোমনাথের বাড়ীতে বিশ্বনাথদাকে দেখে জানলাম তিনি সোমনাথেরই বড়দা। তাই আলাপচারিতাও বেড়ে গেল। এদিকে আমাদের পাশের বাড়ীতেই থাকতেন প্রাক্তনী বিমল সেনের তিনভাই – আমার বাবার ছাত্র। বিমলদা তখন ময়ুরাক্ষী প্রজেক্টে কর্মরত। প্রত্যেক রবিবারই আসতেন ভাইদের সঙ্গে সময় কাটাতে। তিনিই আমাকে ড্রয়িং শিখিয়েছিলেন যাতে আমি অ্যাডমিশন টেস্টে স্কলারশিপ পেতে পারি। অল্প কদিন বাদেই তিনি বি ই কলেজে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন।
ইন্টারভিউয়ের অভিজ্ঞতা প্রায় অসিতদার অনুরূপ, শুধু বরদা চ্যাটার্জি বাবার সহপাঠী ছিলেন তাই তিনিই একমাত্র পরিচিত সেইখানে। প্রিন্সিপাল অতুল রায় জিজ্ঞাসা করলেন আমি হাওড়া ব্রীজ পেরিয়ে এসছি কিনা। আমি হ্যাঁ উত্তর দিতেই জিগ্যেস করলেন কি রং। আমি উত্তর দিলাম আ্যালুমিনিয়াম – সদ্যই ব্রীজ রং করা হয়েছিল। পরের প্রশ্ন অ্যালুমিনিয়ামের কেন? আমি একটু থমকে উত্তর দিয়েছিলাম যে স্টিলের ওপর আ্যালুমিনিয়াম রং করা হয়েছে বলেই আমার ধারণা। অপর কেউ প্রতিপ্রশ্ন করলেন আমি কি নিশ্চিত হয়ে বলছি? আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আমি এখনও ইঞ্জিনীয়র হইনি স্যার।
আমার ফর্মে লেখা ছিল প্রথম ইলেকট্রনিক্স, দ্বিতীয় ইলেক্ট্রিক্যাল, তৃতীয় সিভিল – আমার ইচ্ছা। বাবা বিমলদার সঙ্গে আলোচনা করে পরিবর্তন করে সিভিলকে প্রথমে বসান। অতুল রায় সংশোধনের কারন জানতে চাইলেন। আমি অকপটে বাবার বিমলদার সঙ্গে আলোচনার কথা জানালাম। হয়ত আমার উক্তি বা অভিব্যক্তিতে নৈরাশ্যের আভাস ছিল, বললেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংএও আনন্দ পাবে। হয়ত তাদের আশীর্বাদেই আমি কর্মজীবনে সব ডিসিপ্লিনের শিক্ষা ও সফল প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছি।
বিরাট আশা করেছিলাম বি ই কলেজে ঢুকে মুক্তির স্বাদ পাব। সে গুড়ে বালি। অভিভাবকের দায়িত্ব নিলেন বিমল সেন ও বরদা চ্যাটার্জি। এদিকে মেশোমশাইয়ের ভাই রমাপতি গাঙ্গুলী – মেটালার্জির অধ্যাপকও যোগ দিলেন। আবার বাবা একদিন বরদাবাবুর বাড়ীতে অশোক সান্যালের সঙ্গে আলাপে খবরদারির অনুরোধ করে বসলেন। ফলে চার বাড়ীতে পালা করে হাজিরা দিতে দিতে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হত। আমি তখন প্রথমবর্ষের ছাত্র, থাকি ডাউনিং হলে। তবুও তারমধ্যেও বাস কন্ডাক্টর ঠেঙ্গান, মধ্যরাত্রে বোটানিকাল গার্ডেন পরিভ্রনন ইত্যাদি চালিয়ে গেছি।
সেকালে ওভালে বিরাট মেরাপ বেঁধে স্টেজ করে ৩/৪ দিন ধরে বার্ষিক প্রাক্তনী সম্মেলন – মানে Annual Reunion – হত। একদিন সমস্ত রাত্রিব্যাপি সঙ্গীতের অধিবেশন করা হত। প্রথম দিকে বর্তমান ছাত্ররা গান বাজনা শোনাতেন। এতদিন বাদে, কারুর নামই মনে নেই একমাত্র আর্কিটেকচারের দেবীপ্রসাদ বসু মল্লিক ও রোহিনীলাল মুণিচক্রবর্তি ছাড়া। রাত বাড়লে, প্রসিদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী যেমন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (প্রাক্তনী), সুনন্দা পষ্টনায়ক, শিশিরকণা ধরচৌধুরী, আলি আকবর খান- আসতেন তাদের কলা কুশলতা পরিবেশন করতে। সেবারে শ্যাম গাঙ্গুলী সরোদ বাজাতে এসেছেন। এঁরা সবাই বেশ কিছুক্ষণ আগে এসে যন্ত্র বাঁধেন এবং রেওয়াজ করেন অন্তরালে বসে। সাধারণত সেই স্থান ছিল সেন হলের কমনরুম। আমার ওপর ভার তাদের পরিচর্য্যার। আমাদের পাড়ার বাসিন্দা, বাবার বন্ধু শ্যামকাকা আমাকে দেখে করুণ স্বরে বললেন, বাবা, দেখ ত’, আমার পছন্দমতন পান সাজিয়ে আনতে পারিস কিনা’। রাত তখন প্রায় দেড়টা বাজে। ফাস্ট গেটের বাইরে পানের দোকান খুলিয়ে শ্যামকাকার পছন্দ মতন পান সাজিয়ে আনলাম। তিনি পেয়ে খুব খুশী, পরের দিনই কানাইদাকে জানালেন ছেলের সুখ্যাতি।
শেষদিন বর্তমান ও প্রাক্তনী সম্মিলিত দল নাটক পরিবেশন করতেন। ব্ল্যাকস্মিথশপের ফোরম্যান অশোক ভঞ্জ নির্দেশনা করতেন। প্রায় দু’ মাস, সপ্তাহে একদিন তার মহড়া হত সেন হলের কমনরুমে। স্টেজের সামনের দিকে তার ঝুলিয়ে ৪টা বা ৫টা মাইক লাগান হত – মোটামুটি ২০ ফুট অন্তর এবং অভিনেতার থেকে ৬/৭ ফুট ওপরে। সেকালে মাইকও এখনকার মতন শক্তিশালী ছিলনা। তাই ক্যাচেল্লা টপকে ডায়লগ দর্শকদের কানে পৌঁছনর জন্য অভিনেতাদের অমাইক কন্ঠস্বর অভ্যাস করতে হত। অশোক ভঞ্জ সেই ব্যাপারেও নির্দেশ দিতেন।
১৯৫৭ সালে প্রথম বছরেই দেখি একটি গুলি করে খুনের দৃশ্য। খুনী খেলার পিস্তল চালায়, উইংসের ধারে একজন সময়মতন চাবিপটকা ফাটানর কথা। কোন কারনে পটকা ফাটল না। অভিনেতা কিছুক্ষণ ধরে হাতের পিস্তল নাড়াচাড়া করে দেখল, আসলে আবার চাবিপটকা তৈরী করার সুযোগ দিল। খুনী আবার পিস্তল চালাল, সেবারেও ফাটল না। সুধীন সরকার যেখানে চাবিপটকার লোক সেইখানে পিস্তল ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, ডায়লগ দিলেন – “শালা, আজকালকার পিস্তল, গুলিও জাল।, তিনি এগিয়ে গিয়ে গলা টিপেই খুনের দৃশ্যের ইতি করলেন। গুলি খেয়ে পড়া আর গলা টিপে ছটফট করে পড়া সম্পূর্ণই আলাদা রূপ। বলাই বাহুল্য, সহ অভিনেতাও সমান পারদর্শী। তিনিও ছটফট করার দৃশ্য সুন্দর অভিনয় করলেন।
শুনেছি আমার বাবা অভিনয় করতেন, তবে আমার দেখার সুযোগ হয় নি। তবে আমার মামা শিশির বটব্যাল অনেক বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন। আরেক মামা শীতলদাস বটব্যাল বম্বেতে প্রদীপকুমার নামে খ্যাতি অর্জন করেছেন। সুধীন সরকারের অভিনয়ের স্ফুলিঙ্গ আমাকে আকৃষ্ট করে। পরের বছর থেকে আমিও অভিনয়ে যোগ দিই। আকৃতিতে ছোট, দাড়ি-গৌফ গজায়নি, গলার স্বরও চিকন। আর সেকালে ত’ মহিলা ছাত্রী ছিলনা, তাই শাড়ী জড়িয়ে, পরচুলার খোঁপা লাগিয়ে যুবতীর ভূমিকায় অভিনয় করেছি। স্টেজে থাকাকালীন সহপাঠীরা অনেকেই প্যাক দিত। কিন্তু অল্পক্ষণেই বুঝতাম সেটা তাদের অভিনন্দনের প্রকাশ।
প্রসঙ্গত বলি, সুধীন সরকার পরবর্তীকালে নাট্যকার বাদল সরকার নামেই প্রসিদ্ধ ।
বাদলদা, আপনি আমার সম্রদ্ধ প্রণাম নেবেন। আপনার সান্নিধ্যে ও সাহচর্য্যে যে আনন্দ পেয়েছি তা যেন আজীবন থাকে। আশীর্বাদ করবেন।
•