মাংস হতে তখনো অনেক বাকি। নচিদা একটু ঝোল মুখে ফেলতেই মুখটা কুঁচকে গেল। পরমুহূর্তেই কোঁচকান মুখ লম্বালম্বিভাবে প্রসারিত করে ঘোষণা – “সুদ্দুকে ফায়ার করা হবে। কিছুই হয়নি।” সুদ্দু কাঁচুমাচু মুখ করে বললো – “আগে পুরোটা হতে দাও, তারপর না হয় টেস্ট করবে।” সুদ্দু তো বলে দিল কিন্তু ভেতরে প্রচণ্ড টেনশনে। তারপর আমাকে আর সঞ্জীবকে মাঝে মাঝে ডেকে একটা প্লাস্টিকের চামচে চরণামৃত মুখে দেওয়ার মতো মাংসের ঝোল দিয়ে জিজ্ঞেস করছে – ঠিক আছে? বিজ্ঞের মতো ভাব করে কিছু বলতে যাব, সুদ্দুও ততক্ষণে চেখে বলছে – কি একটা মশলা নেই যেন? বলে মশলার প্যাকেট খুলে কি সব মশলা মেশানো শুরু করল। তার আমি নাম গোত্র কিছুই জানিনা। সুদ্দু পুরো টেন্সড, কানে কানে বললাম – “কিছু না থাকলেও চলবে। শুধু এই আবেগটা যেন থাকে। বি ই কলেজিও আবেগ। তাহলেই চলবে।“
আবেগ এতটাই ছিল যে এবারে রেকর্ড টার্ন আউট। সংখ্যার হিসাবে প্রায় সত্তর। এতলোক নিয়ে পিকনিক আগে কখনো হয়নি। মেনু বলার মতো কিছু নয়। সকালের জলখাবারে ফুলকো লুচি, সঙ্গে ছোলার ডাল আর হাতে বানানো বোঁদে। আর দুপুরে ছিল ভাত, স্যালাড, ডাল, ঝুরি ভাজা, বেগুন ভাজা, আলু ফুলকপি, ইলিশ মাছ, ইলিশের তেল, খাসির মাংস, ইলিশের মাথা দিয়ে ছ্যাঁচড়া, চাটনি, ওপরে লাল স্তর দেওয়া দই আর সন্দেশ। খুবই সাদামাটা। যাঁরা এই সাধারণ মেনুতে খাবার কিছু পাবেন না তাদের জন্যে অতিরিক্ত ছিল ডিমের ডালনা, চিকেন, পটোলের কোরমা, পনিরের মত যৎসামান্যই কিছু আয়োজন।
আমাদের কারো সঙ্গে কোনো কম্পিটিশান নেই। আমাদের পিকনিক আমাদের কলেজের মতোই পুরানো। সেই দেখে নাকি অনেকে অনুপ্রাণিত হয়। ভালোই তো। আমার বৌ যাদবপুরের। আমি ডিপেন্ডেন্ট কোটায় ওদের পিকনিকে যাই এই কয়েকবছর ধরে। চুপচাপ থাকি। ট্যাঁ-ফোঁ কিছু করি না যদি বের করে দেয় সেই ভয়ে। শ্রীরূপাও যাদবপুরের। তাই সঞ্জীবের কথায় সে নাকি যাদবপুরের জামাই। ওখানে গিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় জামাই সুলভ ভঙ্গিতে। নিশ্চয় কেউ পাত্তা দেয় নাহলে অমনি করে ঘুরে বেড়াবে কেন। আমাদের বৌদের সঙ্গে আমরা পিকনিকে জামাইয়ের মতো ব্যবহার করি। ওদের আগে খেতে দিই যত্ন করে। আমাদের খাবার দেখে বৌ বলে – “মনে হচ্ছে তোমাদের মেয়ের বিয়ে লেগেছে।“ আমি বলি কেন – যাদবপুরেও তো ভালো খাওয়ায়। কথাটা বলার পর বৌ এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন বিশাল একটা মিথ্যা কথা বলছি। আবার বলছি আমাদের কারো সঙ্গে কোন কম্পিটিশন নেই।
কি বলতে কি বলছি? কাজের কথায় ফিরে আসি। বলছি যে সকাল আটটার সময় নচিদা তার বায়োমেট্রিক স্টোভ নিয়ে চলে এসেছিল লুচি ভাজার জন্যে। বায়োমেট্রিক এ জন্যেই নচিদার স্টোভ একমাত্র নচিদার হাতেই জ্বলে। খুব বড়সড় দেখতে, অনেক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের খুঁটিনাটি আছে তার মধ্যে – এয়ার ফুয়েল মিক্সচার নাকি কন্ট্রোল করতে হয়। জ্বললে তার ফ্লেম দেখা যায় না। ফ্লেম দেখা গেলে আবার রান্না হতে চায় না। নচিদার সেই স্টোভে নাকি মাছ ভাজা হবে। তেল ঢেলে শঙ্করদা আর ভাস্করদা হত্যা দিয়ে পড়ে আছে, তেল কখন ফুটবে। মাথার ওপর রোদ ছিল তাই রক্ষে তেল অবশেষে ফুটল। তারপর শঙ্করদা আর ভাস্করদা মাথা ঠান্ডা রেখে গভীর অধ্যাবসায় সহকারে ষাট জনের একশো কুড়ি পিস মাছ ভাজছে তো ভেজেই চলেছে। মাছের মাথাগুলোকে অবজ্ঞায় গড়াগড়ি খেতে দেখে শঙ্করদার বৌ রুবিদি মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি। বললো – ইলিশের মাথা আর তেল দিয়ে ছ্যাঁচড়া বানাব। আমরা বললাম – কে বানাবে? সুদ্দুর ওদিকে মাটন করতে গিয়ে চাকরি নিয়ে টানাটানি চলছে। ও বানাতে পারবে না।” রুবিদি বললো – “আমি বানাব।” বলেই সামনে একটা বাচ্চা ছেলে, মনে হয় চিরঞ্জিত, কিছুদিন আগে পাস করে বেরিয়েছে তাকে বললো – “যাও ক্রোগার থেকে কুমড়ো, মূলো, আলু আর পালং শাক নিয়ে এস।” চিরঞ্জিত একটু রোগা প্যাংলা টাইপের, তাই স্যাট করে চোখের আড়ালে চলে যেতে কোনো প্রব্লেম হয়না। এতক্ষণ তাই করছিল। বৌয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কোনো কাজকম্মো না করেই। নতুন বিয়ে করেছে বোধহয়। তাকে খপাৎ করে ধরে ছ্যাঁচড়ার বাজার করতে বলবে সে বোধহয় কল্পনা করতে পারেনি। যাইহোক বেচারা নিজের চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ছোট ছোট তিনটে পালং শাকের প্যাকেট কিনে আনলে রুবিদি চিরঞ্জিতকে নয় তার বৌ কে ডেকে সে কি বকাঝকা। ” হ্যাঁ, বরটাকে মানুষ করতে পারনি। এই দ্যাখো ছ্যাঁচড়ার বাজার করেছে। তারপর আবার পেঁয়াজ নেই। ছেলেদের ছেড়ে দিলে তারা মাথায় চড়ে বসবে কিন্তু।” তারপর শুরু হলো রুবিদির ম্যাজিক। নচিদার সেই বিখ্যাত স্টোভে ছ্যাঁচড়া শুরু হলো। সে হচ্ছে তো হচ্ছেই। কিন্তু যখন হলো – মাই গড! হেভেনলি! বললাম না, আবেগটাই শেষ কথা। ছ্যাঁচড়া কখনোই প্ল্যানে ছিল না, কিন্তু সেটাও হলো – আমাদের অনেকের মতো যাদের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কোন প্ল্যান না থাকলেও শেষ পর্যন্ত হয়ে গেছিল।
ওদিকে তখন জমিয়ে আড্ডা। আমাদের কলেজের আবার আড্ডার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। বি ই কলেজের পাবলিক একা থাকলে হয় উপন্যাস পড়ে না হয় কবিতা লেখে না হয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভাবে, দুজন থাকলে গান শোনে, তিনজন থাকলে আরেকজনকে জুটিয়ে নিয়ে ব্রিজ খেলে আর তার বেশি হয়ে গেলেই কলেজের মেয়েদের নিয়ে চলে সুখ দুঃখের আলোচনা। তার ব্যতিক্রম এবারেও হয়নি শুধু মাঝে মাঝে বউরা এসে পড়লেই আলোচনায় কখনো আটলান্টার পুজো কখনো বা দেববাবুর মাংসে ঘুরে গিয়ে আবার যথাস্থানে ফিরে আসে।
যাইহোক ততক্ষণে রক্তিমদার মাইক হাতে অমায়িক এনাউন্সমেন্ট – খাবার রেডি। প্রথমে ষাট থেকে পঁয়ষট্টির মধ্যে যারা পাস করেছে তাদের, তারপর পঁয়ষট্টি থেকে সত্তর। প্রতিবছর অসিতদা থাকেন। এবারে পারেন নি। থাকলে ওটা “পঞ্চান্ন থেকে ষাট” থেকে শুরু হতো। শুদ্ধাশীস তখন প্রমাদ গুনছে চাকরিটা থাকলে হয়। প্যাটেলর সবরকম মশলা মিশিয়ে সঞ্জীবকে দিয়ে বেশ কয়েকবার টেস্টও করিয়েছিল মাংসটা। শেষমেশ নচিদা বললো – মাংস ভালো হয়েছে বলে সুদ্দুর নাচানাচি করার কোন কারণ নেই, দেব বাবুর পাঁঠাটা অনেক ভদ্র পাঁঠা ছিল।
এভাবেই বছরের একটাদিন আমরা সবাই মিলে জড়ো হই। জড়ো হই তিনটে প্রজন্ম একসাথে। ধরতে চেষ্টা করি গঙ্গা দিয়ে বয়ে যাওয়া ফেলে আসা সেই সময়টাকে, বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে সেই ঘড়িওয়ালা ক্যাম্পাসটাকে। যেখানে জীবনের কয়েকটা বছর বন্ধুদের সাথে প্রতিটা সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যে কেটেছে। কেটেছে ঘুমের মধ্যে রাত। জীবনের কৈশোর। যেখানে এতগুলো রাত কাটে সে তো মনের অজান্তেই কখন বাড়ি হয়ে যায়। নেহাত একটা ডিগ্রী নয় দিয়েছে অনেক কিছুই – কত স্মৃতি, কত বন্ধু। দিয়েছে আজকের ‘আমি’কে। দিয়ে যাচ্ছে এখনো কোন না কোনভাবে – আমার উপলব্ধিতে, আমার বোধে, আমার গভীরে কোথাও। তার টান অমোঘ, দুর্বার। সেই টানেই ছুটে আসেন পার্থদার মতো মানুষ, (১৯৬২ সালের সিভিল) অস্টিন টেক্সাস থেকে। তার পাশে দাঁড়িয়ে ফটো তোলে ২০২৩ এর দ্যুতিময়। মাঝে আমরা, তিন তিনটে প্রজন্ম – সম্ভাবনাময় সকাল, তপ্ত দুপুর, পড়ন্ত আলোর গোধূলির মতো বেঁধে বেঁধে থাকি। এই তিনটে প্রজন্মকে একসাথে বেঁধে রাখে যে আবেগ সেটাই কারো কাছে বি.ই কলেজ, কারো কাছে বেসু, কারো কাছে বা আই আই ই এস টি। বছরে একটা দিন না হয় থাকল সেই আবেগের স্বীকৃতির উদযাপনের দিন হয়ে। •
Recent Comments